বর্তমানে সারা পৃথিবীর তরুণ প্রজন্মের জন্য ক্ষতিকারক বিষয়গুলো নিয়ে যদি একটি তালিকা বানানো হয় তাহলে তালিকার সবচাইতে উপরের দিকে থাকবে মাদকাসক্তি। মাদকের ক্ষতিকর প্রভাব এতটাই বেশি যে জাতিসংঘ ১৯৯১-২০০০ সাল পুরো একটি দশকে মাদকবিরোধী দশক হিসেবে ঘোষণা করেছে। আর ২৬ জুনকে মাদকবিরোধী দিবস হিসাবে ঘোষণা করেছে । বিশ্বের ধনী গরীব সব দেশেই মাদকাসক্তি সমস্যার শিকার। এটি শুধু একটি মানসিক সমস্যা নয় বরং এর সাথে জড়িয়ে আছে আর্থসামাজিক বহুবিধি সমস্যার অবিচ্ছেদ যোগসূত্র।
সারা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশে মাদকাসক্তির শিকারে পরিণত হয়েছে। আমাদের দেশের যুবসমাজের বড় একটি অংশ এই সমস্যায় জর্জরিত। এর জন্য সমাজে দেখা দিচ্ছে নানা রকম বিশৃঙ্খলা, অশান্তি, হতাশা ,অন্যায় ,অত্যাচার,অবিচার ইত্যাদি। এই সমস্যাটি বর্তমানের আধুনিক সুস্থ সমাজের জন্য বিরাট একটি অভিশাপ। তাহলে এতটা খারাপ জেনেও মানুষ কেন মাদক গ্রহণ করে। আর মানুষ কেনই বা মাদক ছাড়তে পারে না বা ছাড়াতে পারে না। তাই চলুন আজ আমরা জেনে নেই মাদকাসক্তি প্রতিরোধের উপায় গুলো সম্পর্কে:
মাদকাসক্তি কি
মাদকাসক্তি হচ্ছে একটি স্নায়বিক ধারণা। এর প্রভাবে নেশাগ্রস্ত ব্যক্তির আচার-আচরণে অসংগতি দেখা দেয়। মাদকাসক্তি বলতে বোঝায়, কোন ব্যক্তি যদি প্রাকৃতিক বা বৈজ্ঞানিক ভাবে তৈরি কোন ঔষধ কোন কারণ ছাড়াই বারবার সেবন করে এবং ওই ওষুধের উপরে শারীরিকভাবে বা মানসিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তাকেই মাদকাসক্তি বলা হয়।
মাদকাসক্তির কারণ
কোন ব্যক্তির মাদকাসক্তি হওয়ার পিছনে অনেক কারন থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হল:
১) অসৎ সঙ্গ: আমাদের দেশে মাদকাসক্তির অন্যতম কারণ হচ্ছে অসৎ সঙ্গ। স্কুল ,কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় অধিকাংশ তরুণ-তরনীরা মাদক গ্রহণ করে তাদের বন্ধু-বান্ধবের পাল্লায় পড়ে। পাড়া, মহল্লার খারাপ সঙ্গ ও আড্ডা থেকে এটি ছড়িয়ে পড়ে। অধিকাংশেরাই নেশা শুরু করার আগে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে জানে না।বর্তমানে অসৎ সঙ্গের কারণে স্কুল কলেজের কোমলমতি বাচ্চারা মাদকের ছোবলে পরে জীবন দুর্বিষহ করে তুলছে।
২) হতাশা: মাদকাসক্তের সংখ্যা বৃদ্ধির সবচাইতে বড় কারণ হচ্ছে যুবসমাজের হতাশা। যুব সমাজ প্রধানত, বেকারত্ব, পারিবারিক বিশৃঙ্খলা, প্রেমে ব্যর্থ, দারিদ্রতা, ও একাকীত্ব থেকে এই হতাশার সৃষ্টি। তারাই হতাশা থেকে মুক্তি পেতে বিভিন্ন ধরনের মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে।
৩) মাদকদ্রব্যের সহজ প্রাপ্যতা: আমাদের দেশে মাদকাসক্তির আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে মাদকের সহজলভ্যতা। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ,নেপাল ও মায়ানমারে মাদকাসক্তির পরিমাণ অনেক বেশি যার কারণে বর্ডার পার করে খুব সহজেই মাদক আমাদের দেশে আসতে পারে। এক শ্রেণী অসাধু ব্যবসায়ী ও সরকারি চাকরিজীবীদের কারণে মাদক খুব সহজেই আমাদের দেশে ঢুকে। কেউ ইচ্ছা করলে মাত্র ১০ টাকা দিয়ে গাঁজা সেবন করতে পারে। মাদক দ্রব্যের এই সহজ প্রাপ্যতা যুব সমাজ কে মাদকের দিকে ঠেলে দেয়।
৪) বেকারত্ব: বেকারত্ব আমাদের দেশে যুবকদের জন্য চরম অভিশাপ হিসেবে দেখা দিচ্ছে। বেকার সমাজের বোঝা এবং নিজের কাছেও প্রবঞ্জনার শিকার। বেকারত্ব জীবন ক্রমশ ব্যক্তিকে হতাশ করে তোলে। আর এই হতাশা দূর করতে ব্যক্তি বিভিন্ন ধরনের মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে।
৫) সামাজিক অস্থিরতা: আমাদের দেশে সামাজিক অস্থিরতার কারণেও মাদকাসক্তির ঘটনা ঘটছে। পারিবারিক সংঘাত, জাতিতে জাতিতে দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ইত্যাদি সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। আর এই সামাজিক অস্থিরতা থেকে মাদকাসক্তি বৃদ্ধি পায়।
৬)অসাধু ব্যবসায়ী: আমাদের দেশের এক শ্রেণী অসাধু ব্যবসায়ীরা মাদকের ব্যবসার সাথে জড়িত। তারা সমাজের প্রতিটি স্থানে মাদক পৌছিয়ে দিতে সক্ষম। এ ব্যবসা খুবই লাভজনক। ব্যবসায়ীর অল্প সময় অধিক মুনাফা লাভের লক্ষ্যে এসব ব্যবসায় অর্থ বিনিয়োগ করে।
৭) বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান: আন্তর্জাতিক মাদক পাচারের রোড হিসেবে পরিচিত গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল ও গোল্ডেন ক্রিসেন্ট এগুলো বাংলাদেশের খুব কাছাকাছি অবস্থিত। এসব রুটের খুব কাছাকাছি বাংলাদেশর অবস্থান হওয়ার কারণে খুব সহজে আমাদের দেশে মাদকদ্রব্য প্রবেশ করে।
৮) পিতা -মাতার মাদক গ্রহণ: আমাদের দেশে অনেক দম্পতি মাদক গ্রহণ করে। তাদের সন্তান ও তাদের দেখাদেখি মাদক সেবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের ঝিনাইদহ ,যশোর সহ বিভিন্ন অঞ্চলে পরিবারের সদস্যরা সবাই মিলে একসাথে মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে।
৯) অপসংস্কৃতি: আমাদের দেশে অনেক অপসংস্কৃতি ছড়িয়ে আছে। এছাড়াও দেশে ইন্টারনেটের সেন্সর বিহিন ওয়েবসাইট, বিভিন্ন নাটক সিনেমায় মাদকদ্রব্যের অপপ্রচার। এসব কারণে সমাজে ধীরে ধীরে মাদকাসক্তির পরিমাণ বাড়ছে।
১০) সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়: আধুনিক শিক্ষা, পরিবার ও শিক্ষকদের সাথে সন্তানের সম্পর্কের অবরতি ইত্যাদির কারণে যুব সমাজ মূল্যবোধের অবক্ষয়ের শিকার। বর্তমানে আমাদের সমাজ থেকে মূল্যবোধ প্রায় উঠেই গেছে। সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে এদেশে যুবকরা সহজেই মাদকাসক্তিতে আসক্ত হচ্ছে। বর্তমানে মাদক গ্রহণকে স্বাভাবিক প্রয়োজন বা স্ট্যাটাস বজায় রাখার উপায় হিসেবে গ্রহণ করা হচ্ছে।
১১) ব্যক্তিত্বের ভিন্নতা: আমাদের দেশে অনেক পরিবারই দেখা যায় একটি সন্তান মাদকদ্রব্য গ্রহণ করছে কিন্তু অপর সন্তান মাদকদ্রব্য গ্রহণ করছে না। মূলত সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে মানুষের ব্যক্তিত্বের ভিন্নতা দেখা যায়। এজন্য নির্দিষ্ট ব্যক্তিত্বের লোকেরাই মাদক গ্রহণ করে।
১২) মানসিক অবস্থা: মানুষের মানসিক অবস্থা মাদকাসক্তির কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। কোন ব্যক্তি যদি মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি না পায় তাহলে সে সমাধানের পদ্ধতি হিসেবে মাদককে বেছে নেয়।
১৩) ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়: পৃথিবীতে ধর্মের নামে রাজনীতি ,সমাজনীতি ও ধর্মের অপপ্রচার করা এক শ্রেণী অসাধু লোকের কারণে মানুষ দিন দিন ধর্মের পথ থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে। ইসলামসহ পৃথিবীর অনেক ধর্মে মাদকের নিষিদ্ধ করা হলেও মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে মাদকাসক্তির পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে।
মাদকাসক্তি প্রতিরোধে যা করণীয়
আমাদের দেশে শিশু ,কিশোর ,যুবক, বৃদ্ধ ,চাকরিজীবী, কৃষক ,শ্রমিক, উপজাতি, যৌনকর্মী ব্যবসায়ী, শিল্পপতি সহ সমাজে সর্বস্তরে মানুষই মাদকাসক্তির কবলে আচ্ছন্ন। এজন্য মাদকাসক্তি প্রতিরোধে সমাজের মানুষকে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। চলুন মাদকাসক্তি প্রতিরোধের উপায়গুলো জেনে নিই:
১) প্রচার মাধ্যমে প্রচার: মাদকাসক্তি যে সমাজের জন্য চরম একটি সমস্যা এই সত্যটিকে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে। টেলিভিশন ,বেতার ,সংবাদপত্রসহ বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে মাদকাসক্তির কুফল গুলো বেশি বেশি প্রচার করতে হবে। মাদকাসক্তির কুফল গুলো বেশি বেশি প্রচারের ,মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে।
২) পথনাটক: মাদকাসক্তির ক্ষতিকারক দিক, এর প্রভাবে সমাজের ক্ষতিকর দিকগুলো পথনাটকের মাধ্যমে উপস্থাপন করতে হবে। জনগণের দ্বারপ্রান্তে এভাবে পথনাটকের মাধ্যমে মাদকের ক্ষতিকারক দিকগুলো তুলে ধরলে সমাজের মানুষ সচেতন হবে।
৩) ধর্মীয় উপসনালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আলোচনা: ধর্মীয় উপাসনালয় যেমন, মসজিদ , মন্দির ,গির্জা ইত্যাদির ইমাম ও পুরোহিত গনের মাধ্যমে মাদকাসক্তির ক্ষতিকারক দিকগুলো জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সহায়তায় মাদকের ক্ষতিকারক দিকগুলো শিক্ষার্থীদের জানাতে হবে।
৪) ডকুমেন্টারি সিনেমা প্রদর্শন: আমাদের দেশের মানুষের সিনেমার প্রতি বিমুখ প্রবণতা থাকলেও ডকুমেন্টারি সিনেমা প্রদর্শন করা যেতে পারে। একজন মানুষ মাদকের কবলে পড়ে কিভাবে তার সবকিছু হারিয়ে ফেলছে সে বিষয়ে ডকুমেন্টারি সিনেমা তৈরি করে জনসম্মুখে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে।
৫) গবেষণা পরিচালনা: বিভিন্ন গবেষণা পরিচালনার মাধ্যমে মাদকাসক্তি নিরাময়ের গ্রহণযোগ্য উপায় বের করতে হবে। তবে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল কার্যকরী করে তুলতে হবে।
৬) মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র স্থাপন: মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র স্থাপনের জন্য সমাজের বিভিন্ন সংস্থাকে পরামর্শ প্রদান ও প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানে আগ্রহী হতে হবে।
৭) চিকিৎসা পরবর্তী পুনর্বাসন: মাদকাসক্তদের সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলা সম্ভব। সমাজ কর্মীকে চিকিৎসা পরবর্তী সামাজিক পুনর্বাসনের জন্য যাবতীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
মাদকাসক্তি নিরাময় পরিবারের দায়িত্ব
মাদকাসক্তি প্রতিরোধে পরিবার একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে। কারণ পরিবার হচ্ছে শিশুর প্রথম প্রতিষ্ঠান। পরিবার থেকেই শিশু তার সবকিছু শিক্ষা পায়। পরিবারের অল্প কিছু চেষ্টায় শিশু মাদকাসক্তি দূর হয়ে যেতে পারে। চলুন মাদকাসক্তি নিরাময় পরিবারের দায়িত্ব গুলো নিয়ে আলোচনা:
১) পরিবারের প্রথম কর্তব্য হচ্ছে, আপনার সন্তানকে বুঝতে শিখুন। অযথা সন্তানের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি করবেন না। সন্তানের ভালোলাগা খারাপ লাগাকে গুরুত্ব দিন।
২) সন্তানকে সময় দিন। সন্তানকে এমন ভাবে সময় দিবেন যেন সে সেটি উপভোগ করে। এবং বারবার আপনার সাথে সময় কাটানোর জন্য অপেক্ষায় থাকে।
৩) সন্তানের পাশাপাশি পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথেও ভালো সম্পর্ক বজায় রাখুন।
৪) একসাথে বাইরে ঘুরতে যান, একসাথে খাবার খান ও খেলাধুলা করুন। এভাবে সময় কাটালে সন্তানদের সাথে সম্পর্ক ভালো হবে এবং সে আড়ালে গিয়ে নেশা করবে না বা সারাদিন ইন্টারনেটে সময় কাটাবে না। বর্তমানে ইন্টারনেটও আসক্তির পর্যায়ে চলে গেছে।
৫) পরিবারে দাম্পত্য কলহ থাকলে এড়িয়ে চলুন বিশেষ করে শিশুদের সামনে এটা প্রকাশ করবেন না।
৬) অহেতুক সন্তানকে সন্দেহ করবেন না। যদি সন্দেহ হয়ে থাকে তাহলে সরাসরি কথা বলুন। সন্তানকে অন্য কারো সাথে তুলনা করবেন না বা কটাক্ষ করে কথা বলবেন না। অনেক মা-বাবা আছে যারা তাদের সন্তানকে প্রতিবেশীদের সন্তানদের সাথে তুলনা করে কটাক্ষ করে, এতে সন্তানরা কষ্ট পায় এবং মনে বিরূপ প্রভাব ফেলে।
৭) সন্তানের বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করুন। সন্তানের সাথে মাদকের অপব্যবহার ও ক্ষতি নিয়ে আলাপ আলোচনা করুন। কারণ বর্তমানে ইন্টারনেটের যুগে ১২ বছরের শিশুরাও মাদক সম্পর্কে ধারণা পাচ্ছে। শিশুর মাদকের বিষয়ে যদি আগে থেকেই ধারণা থাকে তাহলে পরবর্তীতে গিয়ে মাদক থেকে দূরে থাকা সম্ভাবনা আছে।
৮) সন্তানের উপর কখনোই গোপন নজরদারি করবেন না। ছেলে মেয়ে যদি বড় হয় তাহলে তাদের নিজের আইডেন্টিটি তৈরি হয়। সন্তানকে অযথা দোষারোপ করবেন না যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করুন। ছোটবেলা থেকেই নৈতিক শিক্ষা দিন, ভালো খারাপ সব বিষয়েই যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিন।
৯) কিশোর বয়সে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বন্ধু। সন্তানরা এই সময় পরিবারের চাইতে বন্ধুদের কথা বেশি শুনে। এজন্য সন্তানরা কার সাথে বন্ধুত্ব করেছে সে বিষয়ে সন্তানদের সাথে খোলামেলা কথা বলুন এবং বন্ধু নির্বাচনে পরামর্শ দিন।
১০) সন্তানরা বাইরের আড্ডা, ও হোটেল-রেস্টুরেন্টে কিছু খেতে চাইতে পারে এতে বাধা না দিয়ে পারিবারিকভাবে এগুলো আয়োজনের চেষ্টা করুন। যেমন, ঘরে মুখরাচর খাবার তৈরি করে একসাথে খাওয়া, বিকেল হলে আড্ডা দেওয়া একসাথে খেলাধুলা করা, ছুটির দিনে ঘুরতে যাওয়া ও মুভি দেখা ইত্যাদি।
১১) এই বয়সে ছেলে মেয়েদের হাত খরচের টাকা লাগে। তবে খেয়াল রাখবেন টাকার পরিমাণটা যেন অতিরিক্ত না হয়ে যায়। বেশি টাকা পেলে ছেলে মেয়েরা মাদকের দিকে ঝুঁকতে পারে।
১২) নিজে মাদকাসক্ত হয়ে সন্তানকে মাদক থেকে দূরে রাখার চিন্তা সম্পন্ন অযৌক্তিক। এজন্য নিজে সব সময় ঠিক থাকুন। আপনি যদি নৈতিক পথে চলেন এবং সন্তানকে নৈতিকভাবে চলার উপদেশ দেন তাহলে সন্তান অবশ্যই নৈতিক পথে চলবে। আর পরিবারে যদি অনৈতিকতার সাথে জড়িয়ে থাকে তাহলে সন্তান কখনোই ভালো হবে না।
মাদকাসক্তির কুফল
মাদকাসক্তির কুফল মারাত্মক। মাদকে আসক্তি হলে তরুণ -তরুণীরা বিভিন্ন ধরনের অপকর্মের সাথে লিপ্ত হয়। মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা সমাজ ও জাতির জীবনে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে নিয়ে আসতে পারে যখন একটি ব্যক্তি মাদকাসক্ত হয় তখন তার বিবেক ও বুদ্ধি স্বাভাবিক থাকে না। তখন সে মাদকের টাকা জোগাড় করতে নানা রকম খারাপ কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। মাদকের টাকা জোগাড় করতে চুরি , ডাকাতি সহ নানা ধরনের অপকর্মের সাথে লিপ্ত হয়ে যায়। মাদক কেনার টাকা যদি না থাকে তাহলে পরিবারের যে কোন জিনিস নিয়ে বিক্রি করে দিতে পারে এবং কি বাবা-মা পকেট থেকে টাকা চুরি করতেও দ্বিধাবোধ করে না। তাহলে বুঝতেই পারছেন মাদকাসক্তির কুফল ভয়াবহ।
মাদকাসক্তি থেকে মুক্তির উপায়
মাদকাসক্তি থেকে নিজেকে সরিয়ে আনতে নিজের জীবন যাপন পদ্ধতি এবং অভ্যাসে প্রচুর পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। নেশাদ দ্রব্যের প্রতি আসক্তি কতটা তীব্রতার উপর নির্ভর করে এই আসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার বিষয়টি। চলুন জেনে নেই নেশাদ্রব্যের থেকে নিজেকে রক্ষা করার উপায় গুলো সম্পর্কে:
১) পরিবারের সদস্য ও বন্ধু-বান্ধব: নেশা থেকে বাঁচার জন্য নিজেকে অন্য কোন নেশায় যেমন জুয়া খেলায়, ধূমপান, কিংবা অন্যান্য যেকোনো নেশার দিকে নিজেকে ঠেলে দিবেন না। এ ব্যাপারে আপনি আপনার পরিবার ,বন্ধু বান্ধব এবং কলিগদের সাহায্য গ্রহণ করতে পারেন।
২) মানসিক ও দৈহিক: নিয়মিত শরীরচর্চা করুন। নিয়মিত শরীরচর্চা করলে শরীর থেকে কিছু রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয় যেটা আপনাকে মানসিক ও দৈহিকভাবে শান্তি দিবে।
৩) নেশা ছাড়তে হবে: যদি নেশা ছেড়ে দেওয়ার কারণে আপনার শরীরে কোন সমস্যার সৃষ্টি হয় এবং সেই অজুহাতে আবার নেশা করা শুরু করেন তাহলে এমনটা করবেন না। ভালোভাবে খুঁজে বের করুন এই অবাঞ্ছিত সমস্যার মূল কারণ কি এবং পরবর্তীতে সেই কারণ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুন।
৪) যাতায়াত: যেসব জায়গায় আপনি নিয়মিত নেশাদ্রব্য গ্রহণ করতেন বা নেশাদ্রব্য ক্রয় করতেন ওই সকল জায়গায় যাতায়াত বন্ধ করুন। যে সকল বন্ধু-বান্ধব নেশাদ্রব্য গ্রহণ করে সেই সকল বন্ধু-বান্ধবকে ছাড়ার চেষ্টা করুন। আর যারা নেশাতে গ্রহণ করে না তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে তোলার চেষ্টা করুন।
৫) নিজে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ: নেশা দ্রব্য ছেড়ে দেওয়ার জন্য নিজে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। নিজেই নিজেকে বলতে শিখুন আমি আর নেশা করব না।
৬) মনোরোগ বিশেষজ্ঞ: নেশা ছাড়ার জন্য মনস্থির করতে একজন ভালো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারেন। যদি তার পরামর্শ মেনে চলেন তাহলে আপনি নেশা ত্যাগ করতে পারবেন। এছাড়াও এই সময়ে আপনার নিয়মিত শারীরিক চেকআপ প্রয়োজন।
মাদকাসক্তির চিকিৎসা
মাদকাসক্তের চিকিৎসার কয়েকটি ধাপ রয়েছে। সর্বপ্রথম চিকিৎসার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয় এরপর মাদকাসক্তির ধরণ নির্ণয় করা হয়। এরপরে মানসিক ও শারীরিক পরীক্ষা করা হয়। এরপর তার উইথড্রয়াল সিনড্রোম এবং মাদক প্রত্যাহার জনিত শারীরিক সমস্যার চিকিৎসা করা হয়।
ডিটক্সিফিকেশন এই ধাপটি তে শরীর থেকে মাদকের ক্ষতিকর রাসায়নিক অংশগুলো বের করে দেওয়া হয়। এ সময় তার শরীরের পুষ্টি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ওষুধ প্রদান করা হয়। মনচিকিৎসকের পরামর্শে মাদকমুক্ত করার জন্য বিভিন্ন স্বীকৃত ঔষধ নির্দিষ্ট নিয়মে সেবন করা লাগতে পারে। এরপরের ধাপে মাদকাসক্ত রোগী কে কাউন্সিলিং এর মাধ্যমে মাদক মুক্ত থাকার প্রেরণা দেওয়া হয়। আবার যাতে মাদকে আসক্ত না হয়ে পড়ে সেজন্য তাকে পরামর্শ দেওয়া হয় এবং মাদকাসক্ত হওয়ার যেসব ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ আসে সে সব থেকে দূরে থাকার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য নানাভাবে সাহায্য করা হয়।
তাকে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে উৎসাহিত করা হয়। মাদকাসক্ত হওয়ার আগে তার যে যোগ্যতা ও গুণাবলী গুলো ছিল সেগুলো ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য পুনর্বাসন মূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়। পরিবারের সাথে সম্পর্ক আরো গভীর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না হয়। এসকল ধাপ গুলো বেশ দীর্ঘমেয়াদী। এজন্য ধৈর্য সহকারে চিকিৎসা করাতে হয়। চিকিৎসা যদি অপরিপূর্ণ থাকে তাহলে আবার আসক্তি হতে পারে।
মাদকাসক্তির ফলে কি ধরনের রোগ হতে পারে
মাদকের ভয়াবহতা এতটাই বেশি যে মাদক সেবীর আশেপাশে থাকা মানুষও মাদকের সৃষ্ট রোগ থেকে বাঁচতে পারে না। অন্যের সেবন করা মাদকের ধোয়া গ্রহণ করাকে পেসিভ স্মোকিং বলা হয়। পেসিভ স্মোকিং এর কারণে শিশুদের এজমা, ব্রংকাইটিস, এমনকি নিউমিনিয়া পর্যন্ত হতে পারে। পেসিভ স্মোকিং সরাসরি ধূমপানের চেয়েও ক্ষতিকর।
এছাড়াও যারা অতিরিক্ত মাদকাসক্ত তাদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের রোগ হতে পারে। মাদকাসক্ত থাকাকালীন অবস্থায় তাদের শরীরে অনেক ধরনের পরিবর্তন হয়। যেমন ওজন কমে যায় সেই সাথে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি হয়। মাদকাসক্ত রোগের চরম পর্যায় হচ্ছে ক্যান্সার। যারা মাদকাসক্ত তাদের ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা সবচাইতে বেশি থাকে। এছাড়াও মাদকাসক্ত হলে ডিপ্রেশন, মানসিক রোগ, যৌন রোগ ইত্যাদি হয়ে থাকে।
সবশেষে,
মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে কখনো অবহেলা করা যাবে না। তাকে মাদকের খারাপ দিক সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান দিতে হবে। তাকে মাদকের কুফল গুলো সম্পর্কে জানাতে হবে। মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে অবহেলা করলে তার মাদকের প্রতি আসক্তি আরো বেড়ে যায়। এজন্য মাদকাসক্ত হওয়ার লক্ষণগুলো প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথেই তাকে সঠিক চিকিৎসা করাতে হবে। যেহেতু এটি দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা এই জন্য কোন প্রকার তাড়াহুড়া করা যাবে না ধৈর্য ধরতে হবে। এবং মাদকাসক্তি ব্যক্তির সাথে পরিবারের সকলকে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।
আরো পড়ুন –