ঘামাচি গরম কালে খুব সাধারন একটি সমস্যা। যা ছোট থেকে বড় সবারই হয়ে থাকে। ঘামাচি হচ্ছে ছোট ছোট আকৃতির লালচে ধরনের হয়ে থাকে। সাধারনত হাত, গলা, পিঠ এবং পেটে ঘামাচি বেশি হয়ে থাকে। প্রচন্ড শরীরে যখন আমাদের শরীর থেকে ঘাম বেরিয়ে আসে তখন ঘামের সাথে এক ধরনের ময়লা বের হয়। কিন্ত যদি কোনো কারনে সেই ময়লা বের হতে না পারে তাহলে লোমকূপে আটকে ঘামাচি তৈরি হয়। এই ময়লা বা জীবানুকে এপিডারমাইডিস বলা হয়৷
এপিডারমাইডিস ঘামাচি হওয়ার জন্য দায়ী। ঘামাচি এক প্রকার চর্ম জাতীয় রোগ। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে মিলিয়ারিয়া বলা হয়। এটি একটি ঘর্ম গ্রন্থির রোগ৷ ঘামাচি খুব বিরক্তিকর একটি সমস্যা। কারন ঘামাচি হলে শরীরে অনেক বেশি চুলকানী হয়, শরীর খসখসে হয় মরা চামড়া উঠে আর দেহের সৌন্দর্যের বারটা বাজাতে যথেষ্ট ক্ষুদ্রাকৃতির এই ঘামাচি। তাই গরম এলেই সবার দুশ্চিন্তা বেড়ে যায় কিভাবে ঘামাচির হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়।
আজকের এই আর্টিকেলে আলোচনা করব কিভাবে গরমে ঘামাচির হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করবেন।
ঘামাচি সাধারণত তিন ধরনের হয়ে থাকে। যেমন:
১.মিলিয়ারিয়া কৃষ্টালিনা: এই ক্ষেত্রে ত্বক দেখতে স্বাভাবিক মনে হয় এবং তেমন কোনো উপসর্গও থাকেনা।
২. মিলিয়ারিয়া রুবরা: মিলিয়ারিয়া রুবরার ঘামাচির ক্ষেত্রে ঘর্মনালি বা ত্বকের লোমকূপ বদ্ধ হয়ে যায় এবং ত্বকে ছোট ছোট অসংখ্য গোটা দেখা দেয়। অনেক সময় গোটার মাথায় পানি দেখা যেতে পারে আবার নাও দেখা যায়। রুবরা ঘামাচির ক্ষেত্রে ত্বক স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি লাল হয়ে যায়। এই ঘামাচি বুক, পেট ও পিঠে বেশি দেখা যায় এবং প্রচন্ড চুলকানি হয়।
৩. মিলিয়ারিয়া প্রফান্ডা: এই ঘামাচি ত্বকের অনেক গভীরে হয়ে থাকে। ফলে ত্বকের ভিতর ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
এই তিন ধরনের ঘামাচির মধ্যে মিলিয়ারিয়া রুবরা বেশি ক্ষতিকর বা যন্ত্রনাদায়ক। চিকিৎসা বিজ্ঞানে একে Heat rash বলা হয়ে থাকে। সাধারণত যারা স্যাতসেতে এবং বেশি গরম পরিবেশে থাকে তাদের এই ধরনের ঘামাচি বেশি হয়ে থাকে।
ঘামাচি থেকে মুক্তির উপায়
বরফের সেক
ঘামাচির জন্য বরফের সেক একটি উৎকৃষ্ট উপাদান। কারন বরফ অতিরিক্ত ঠান্ডা হওয়ায় ঘামাচি মরে যায়। তাই ঘামাচি ওঠা স্থানে বরফ নিয়ে কয়েক মিনুট লাগিয়ে রাখতে হবে। এরকম কয়েক দিন বরফ সেক দিলে ঘামাচি দূর হবে।
বেসন
বেসন ঘামাচি দূর করতে সাহায্য করে। পানি সহ বেসন গুলিয়ে ঘামাচি আক্রান্ত স্থানে লাগিয়ে নিন। এবার পনের মিনিট অপেক্ষা করে ধুয়ে ফেলুন। দেখবেন ঘামাচি খুব দ্রুত পালিয়ে যাবে।
মুলতানি মাটি ও গোলাপ জল
মুলতানি মাটি ও গোলাপজল ঘামাচি দূর করতে সাহায্য করে। এই দুটো উপাদান ভালভাবে মিশিয়ে ঘামাচি আক্রান্ত জায়গায় ভাল করে লাগাতে হবে। এবার শুকিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।
নিমপাতা
নিমপাতা খুব ভাল ঔষধি গুনাগুন সম্পন্ন একটি উদ্ভিদ। নিমপাতা রোগ জীবানু ধ্বংস করতে যুগ যুগ ধরে ব্যবহারিত হয়ে আসছে। তাই ঘামাচি তাড়াতে নিমপাতা গোসলের সময় ব্যবহার করতে পারেন। নিমপাতা ব্যবহার করলে ঘামাচি দূর হবে। নিমপাতা রসও ব্যবহার করতে পারেন। নিমপাতা বেটে সেই রস শরীরে মেখে কয়েক মিনিট অপেক্ষা করুন। এরপর ভালভাবে ধুয়ে ফেলুন। ঘামাচি মরে যাবে।
বাইরে থেকে এসে গোসল
বাইরে থেকে এসে ঘাম সহ শুকিয়ে গোসল না করলে ঘামাচি জন্ম নেয়৷ তাই গরমে বাহির থেকে আসলে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল এবং শরীর মুছে ফেললে শরীর ঠান্ডা হয় এবং ঘামাচি হয়না।
প্রতিদিন গোসল
অনেকই আছেন বাইরে থেকে এসে ঠিকমত শরীর পরিষ্কার করেন না। তখন শরীরে ঘাম বসে ঘামাচি তৈরি হয়। তাই গরমে প্রতিদিন অন্তত দুইবার গোসল করতে হবে।
ত্বকের সুরক্ষায় অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম বা লোশন ব্যবহার করতে পারেন। এতে ঘামাচি উঠবেনা বা উঠলেও মরে যাবে।
হলুদ ও ঘৃতকুমারির রস
ঘামাচি তাড়াতে কাচা হলুদের রস এবং ঘৃতকুমারির রস খুব ভাল কাজ করে। হলুদ বেটে হলুদের রসের সাথে ঘৃতকুমারির রস একসাথে মিশ্রন তৈরি করুন। এবার এই রস পুরো শরীরে বা ঘামাচি যুক্ত স্থানে লাগিয়ে নিন। এতে করে ঘামাচি দূর হবে এবং ঘামাচি উঠবেনা।
বেকিং সোডা
ঘামাচি তাড়াতে বেকিং সোডা খুব কার্যকরী একটি উপাদান। পানির সাথে বেকিং সোডা মিশিয়ে তুলা দিয়ে ঘামাচি যুক্ত স্থানে লাগিয়ে নিন এই পানি। একদিনেই ঘামাচি উধাও হয়ে যাবে।
বৃষ্টির পানিতে গোসল
বহু বছর থেকেই ঘামাচি তাড়াতে বৃষ্টির পানি ব্যবহার হয়ে আসছে। বিশেষ করে আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে এই দৃশ্য বেশি দেখা দেয়। বৃষ্টিতে গোসল করলে ঘামাচি দূর হয়। তাই আপনার ঘামাচি তাড়াতে বৃষ্টির পানিতে গোসল করতে পারেন।
ঘরে পর্যাপ্ত বাতাস আসার ব্যবস্থা করুন
ঘামাচি সাধারণত গরম থেকে হয়ে থাকে। তাই আপনার ঘরে যেন পর্যাপ্ত পরিমান বাতাস আসতে পারে সেই ব্যবস্থা নিন। দরজা জানালা খোলা রাখুন এবং গরম বাতাস এড়িয়ে চলুন। এসি বা ফ্যান ব্যবহার করুন এবং গরম এড়িয়ে চলুন।
লেবুর রস
লেবুর রসের রসে রয়েছে anti bacterial উপাদান। যা ঘামাচি দূর করতে সহায়ক। তাই নিয়মিত বেশি করে লেবুর রস সহ পানি পান করুন।
চন্দন
চন্দন বাটা বা চন্দনের গুড়োর সাথে গোলাপজল মিশিয়ে ঘামাচি যুক্ত স্থানে লাগান৷ শুকিয়ে গেলে ধুয়ে ফেলুন। চন্দন ঘামাচি দূর করতে সাহায্য করবে। চন্দনের সাথে ধনে পাতা বাটা মিশিয়ে দিতে পারেন৷ কারন ধনে পাতায় রয়েছে antiseptic গুন যা ঘামাচি দূর করে।
ফিটকিরি
ছেলেরা সেভ করার সময় ফিটকিরি ব্যবহার করে থাকে, অনেকে আবার পানি শোধনের কাজে ব্যবহার করে থাকে। এই ফিটকিরি সমান ভাবে ঘামাচি দূর করতেও সক্ষম। ঘামাচি দূর করতে পানির সাথে ফিটকিরি মিশিয়ে নিন৷ এবার এই পানি পরিষ্কার কাপর দিয়ে ঘামাচি যুক্ত স্থানে লাগিয়ে নিন। দুই এক দিন ব্যবহারের ফলে ঘামাচি চিরতরে বিদায় নেবে।
লাউ
লাউ খুব ঠান্ডা একটি সবজি। ঘামাচি দূর করার জন্য লাউ ঝলসে খেলে ঘামাচি দূর হয়।
আলু
সবার কিচেনে আলু পাওয়া যায়। আলু রূপচর্চায় ব্যবহারের পাশাপাশি ঘামাচি দূর করতেও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আলু পেষ্ট করে ঘামাচি যুক্ত স্থানে লাগিয়ে নিন। ঘামাচি দূর হবে।
ওটমিল
ওটমিল ঘামাচি দূর এবং ঘামাচির চুলকানিতে বেশ ভাল কাজ করে। বাথটাব থাকলে বাথটাবে ওটমিল মিশিয়ে নিন। এবার কয়েক মিনিট ডুবে থাকুন। আপনার সকল জ্বালাপোড়া বা চুলকানি নিমিষেই মিলিয়ে যাবে। আর যদি বাথটাব না থাকে তাহলে পানির সাথে ওটমিল মিশিয়ে গোসল করে নিন।
তরমুজ
গরমে তরমুজ খেতে আমরা কে না ভালবাসি? গরমে তরমুজ আমরা সবাই খেতে ভালবাসি। আপনার যদি ঘামাচি হয়ে থাকে তাহলে তরমুজের পাল্প বের করে ঘামাচিতে লাগিয়ে নিন। নিমিষেই ঘামাচি উধাও হয়ে যাবে।
শসা
শসা আমাদের শরীর কে হাইড্রেট করার পাশাপাশি ঘামাচি দূর করে। পাতলা করে শসা কেটে নিয়ে ঘামাচিতে পনের মিনিট ধরে থাকুন। এতে ঘামাচি দূর হবে৷ এছাড়া শসার সাথে লেবুর রস ঘামাচি যুক্ত স্থানে লাগিয়ে কয়েক মিনিট অপেক্ষা করুন। দুই দিনের মধ্যে ঘামাচি হাওয়ার সাথে মিলিয়ে যাবে!
আদা
ঘামাচি দূর করতে আবার আদাও ব্যবহার করা যায় নাকি! হ্যা অবশ্যই যায় আমাকে পাগল ভাবার কিছু নেই। আদা ঘামাচি দূর করতে সহায়ক একটি উপাদান। আদা স্লাইস করে পানি গরম করে নিন। গরম পানি আবার লাগাতে যাবেন না! পানি ঠান্ডা করে নরম সুতি কাপর দিয়ে ঘামাচি যুক্ত স্থানে লাগিয়ে নিন। এবার কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। তারপর আদার ম্যাজিক দেখুন।
আম
কাচা আমতো গরমকালে সবার ঘরে ঘরে থাকে। ঘামাচি দূর করার অজুহাতে কাচা আমের পানীয় খেতে পারেন। কাচা আম সিদ্ধ করে আম থেকে রস বের করে নিন। এবার স্বাদের জন্য আমের রসের সাথে পানি অল্প চিনি এবং লবন মিশিয়ে নিন। এই পানীয় খেতে যেমন মজাদার পাশাপাশি ঘামাচি দূর করতেও সাহায্য করে।
ঘামাচি দূর করার ফেসপ্যাক
গরমে ঘামাচি দূর করার জন্য ফেইসপ্যাক ব্যবহার করতে পারেন। এই ফেইসপ্যাক বানাতে হলে তুলসি পাতা পেষ্ট করে নিন। এবার তুলসির রসের সাথে লাউ পেষ্ট করে একসাথে মিশিয়ে নিন। এই দুটো উপাদান এর সাথে আতপ চালের গুড়ো মিশিয়ে নিন। ব্যস তৈরি হয়ে গেল ঘামাচি দূর করার ফেইসপ্যাক। ঘামাচি দূর করতে হলে এই ফেইসপ্যাকটি ফেসে লাগিয়ে নিন। অল্প দিনের মধ্যে ঘামাচি দূর হয়ে যাবে।
ঘামাচি হলে কিছু সতর্কতা
- পরিষ্কার ত্বকে কখনো ট্যালকম পাউডার ব্যবহার করবেন না। লোমকূপে আটকে যেয়ে আরো ঘামাচি বাড়াতে সাহায্য করে।
- কখনোই ঘামাচি ঘসবেন না। এতে ত্বক নষ্ট হয়ে যায় এবং ঘামাচি আবার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
- ঘামাচি যুক্ত স্থান চুলকালে বরফ লাগালে আরাম পাওয়া যায়।
- ঘর আলো বাতাস যেন আসতে পারে তাই সব সময় দরজা জানালা খুলে রাখুন।
- নখ দিয়ে ঘামাচি চুলকাবেন না।
- সব সময় সুতি কাপড় পরুন ভুলেও নাইলনের কাপড় পরতে যাবেন না।
- ঘামাচি থেকে পুজ বের হলে দেরী না করে ভাল চর্ম রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
পরিশেষ
গ্রীষ্মকালে ঘামাচি হওয়া মানে মরার উপর খাড়ার ঘা। একে তো অসহ্য গরম সেই সাথে আবার ঘামাচির অত্যাচার। তাই ঘামাচি থেকে দূরে থাকতে হলে গরম থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে। মনে রাখবেন প্রতিকার এর চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। তাই ঘামাচি থেকে নিজেকে সুরক্ষিত থাকতে হলে আরামদায়ক স্থানে থাকুন এবং গরম থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করন। তারপরেও যদি ঘামাচি হয় তার জন্য আমাদের এই আর্টিকেল তো আছেই সমাধান করার জন্য! ঘামাচি দূর করতে অনেক গুলো টিপস দেয়া আছে এগুলোর একটি আ্যপ্লাই করলেই ঘামাচি পালিয়ে যাবে।
আরো পড়ুন –